প্রবন্ধ- বিবাহ- সম্পর্ক? নাকি আত্মিকতা

বিবাহ- সম্পর্ক? নাকি আত্মিকতা
– সঙ্কর্ষণ

 

 

প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র অনুসারে বৈবাহিক সম্পর্ক কখনোই কেবল একটি পুরুষ ও নারীর হ’তে পারেনা, দুটি পরিবারের হয়। দুটি মানব-মানবীর প্রেম হ’তেই পারে, কিন্তু পরিণতি সম্পর্কে দুই পরিবারের নিশ্চয়তা তাতে অবশ্যম্ভাবী। মননের গহীন থেকে গহীনতর অংশের অন্বেষণ মূলতঃ নব্যতার পরিচায়ক… এ শাস্ত্র যে সময়ে রচিত বা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত, সমাজ সে সময় ততোখানি আধুনিকমনস্ক আদৌ ছিলোনা। বিবাহের পূর্বে আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতে অন্তরঙ্গতা সংখ্যায় নগণ্য তো ছিলোই, উপরন্তু পরিণতি অসবর্ণ বিবাহমুখী যাতে না হয় তার পূর্ণ প্রচেষ্টা চালানো হ’তো। সত্যি ব’লতে কী, এই পর্যন্ত সমাজের অনমনীয়তার পরিচয় পাওয়া গেলেও তাতে পুরুষতান্ত্রিকতা প্রকট হ’য়ে ওঠার লক্ষণ খুব বেশী দেখা যায়না।

সমস্যা দেখা দেয় বয়সের পার্থক্যে, দেখা দেয় নারী সম্পর্কে সমাজের বিচারে। দশমবর্ষীয়া বালিকা যখন একুশ থেকে পঁচিশ বছরের তরুণের ঘরণী হ’য়ে আসতে বাধ্য হয়, তখন এই নৈতিক ব্যাখ্যাগুলিই আমাদের পক্ষে চরমভাবে বিরক্তি-উৎপাদক ও হাস্যোদ্রেককারী হ’য়ে ওঠে। দশোর্ধ্ব বালিকা কোনোমতেই বিবাহযোগ্যা নয়, যেহেতু ঋতুমতি আর ‘যমমুখী’ শব্দদ্বয় আপাতদৃষ্টিতে সমার্থক। যে মেয়েটি অত্যন্ত ছোটো বয়সে নিজের ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে অপরিচিত একটি মানুষের সান্নিধ্য পেতে চিরকালের মতো চ’লে যাবে, সে যাতে কোনোভাবেই ‘অচলায়তন’ ভাঙবার দুঃসাহস না দেখাতে পারে সেজন্য শ্বশুরবাড়ির প্রায় প্রতিটি সদস্যই নিজস্ব তাগিদে সচেষ্ট হন। নারীত্বের বিকাশ সম্পর্কে এহেন ঔদাসীন্য সম্ভবতঃ আমাদের পক্ষেই সম্ভব। সামগ্রিকের তুলনায় ব্যক্তিগত স্বার্থ বড়ো হ’য়ে ওঠে ব’লেই হয়তো এককালে স্বয়ং নতিস্বীকৃত হ’য়েও নবাগতাকে সেই একইরকম চাপে ফেলে দিতে পুরবাসিনীরাও দ্বিধা করেননা কোনোদিন, করেনওনি।

জ্ঞানদানন্দিনী সাহেবি কেতায় শাড়ি, জুতো পরার সাহসটুকু দেখাতে পেরেছিলেন কি স্বেচ্ছায়? উত্তর হ’লো ‘না’। তৎকালীন সরকারি আমলা হ’য়ে বয়সে যথেষ্ট বড়ো স্বামী সত্যেন্দ্রনাথও নিজের বাবার সম্মতি পেয়েই সেই অনুমতি দিয়েছিলেন মাত্র। প্রতিপত্তি জনমতের চিৎকার থামাতে পারলেও ফিসফাস সে বন্ধ ক’রতে পারেনি কোনোদিনই আর সেইজন্যই প্রাপ্ত অধিকারটুকুর কারণে ঠাকুরবাড়ির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনে জ্ঞানদানন্দিনীর কোনো কার্পণ্য ছিলোনা। যতোই স্বামীর পাশে ব’সে নাটক দেখার অভ্যাস থাকুক, অধিকাংশ সময়টুকু রান্নাঘর আর দাসদাসীর তদারকিতেই তাঁর কাটতো বইকি।

এখন বিষয় হ’লো, মনস্তত্ত্ব নিয়মের তোয়াক্কা কোনোকালেই না করায় বয়সে সামান্য ছোটো আত্মভোলা দেবরটির ওপর তার আর পাঁচজনের তুলনায় কিছু বেশীই অধিকার ছিলো। তাই বাজার করা ভৃত্যের কন্যাটিকে তার বউ ক’রে ঘরে আনার সিদ্ধান্তকেও তিনি পছন্দ করেননি একেবারেই। পীরালি ব্রাহ্মণ হিসাবে দেবেন্দ্রনাথের পক্ষে এর চাইতে ভালো মেয়ে খোঁজা আর সম্ভবও ছিলোনা। কারণ একে আধা-বামুন তায় ব্রাহ্ম এমন পরিবারকে কন্যাদানে সম্মত হবে তেমন ঘর জোগাড় করাও কঠিন, সে যতো শিক্ষিতই হোকনা কেন। তো যা’ই হোক, তাঁর তরফে তেমন কিছু বাধা আসেনি।

খটকা তখনই দেখা দিলো, যখন কাদম্বরীর অন্তঃস্থিত শিল্পীসত্ত্বাটি জ্ঞানদানন্দিনীর এতোদিনের চর্চাকে ছাড়িয়ে লোকসমক্ষে উঁকি দেওয়া আরম্ভ ক’রলো। বাড়িতে সাহিত্য-আলোচনার আসর হ’লেই তাঁর আগে এই ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ মেয়েটির ডাক প’ড়তে লাগলো। মানবমনের স্বাভাবিকতা অনুসারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরও একটি কিশোরীর প্রতি নজর দেওয়ার অবকাশ তেমন র’ইলোনা। এদিকে ঠাকুরবাড়ি প্রকাশিত পত্রিকার সম্পাদনারও মূল দায়িত্ব সর্বসম্মতিক্রমে কাদম্বরীই লাভ ক’রলেন। শিক্ষিতা ও বনেদী বাড়ির মেয়ে হিসেবে নিজের ক্রমবর্ধমান অভিমানে গুরুত্ব না দেওয়ার চেষ্টা ক’রেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। কিন্তু ঐ যে, দিনের শেষে তো আমরা মানুষই তাইনা?

সদ্য তারুণ্যে উত্তীর্ণ যে দেবরটি কাদম্বরীর থেকে মাত্র বছর দুয়েকের ছোটো ছিলো, সে কিন্তু বুঝেছিলো যে সব পাওয়ার মধ্যেও নারীর একটু হ’লেও না পাওয়া থেকেই যায়। প্রভূত সম্পদের অধিকারিণী, স্বামীর প্রেমিকা না হ’লেও স্নেহের পাত্রী, সীমিত গণ্ডীর মধ্যেও অনেকখানি যশ এসবের বাইরেও পিতৃগৃহের অদর্শন, সন্তানের অপ্রাপ্তি, নিজস্ব গুণাবলীর প্রতি স্বামীর ঔদাসীন্য যাঁকে ক্রমাগতঃ বিঁধেছিলো, তিনি কিন্তু তাঁর চিন্তার সমস্ত বিস্তৃতি ঢেলে দিয়েছিলেন নিত্যদিন নতুনতর সাহিত্যের সন্ধানে দুর্নিবার ছুটে চলা এই দেবরটির ওপর। রবি স্বয়ং এই নির্ভরশীলতা উপভোগ ক’রেছিলো, কিন্তু ব্যবহার করেনি। হয়তো শিল্পীরা এমনই হয়। নিজের সৃষ্টির তুলনায় তারা দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দিতেই জানেনা।

জ্ঞানদানন্দিনী রবির গুরুজন ছিলেন। কিন্তু কাদম্বরী ছিলেন পরমাত্মীয়া। প্রতিভার কিরণ যখন বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে অতি দূর সম্পর্কের আত্মীয়তাও তখন নিকটবর্তী হ’তে সচেষ্ট হয়। স্রষ্টা স্বয়ং যখন আলাদাভাবে কাউকে ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ ব’লে উল্লেখ করেন, অপরেরও যে অমরত্ব প্রাপ্তির ক্ষুধা জ্ব’লে ওঠে তা বলাই বাহুল্য। অতএব কথায় কথা বাড়তে থাকে। কাদম্বরী ঘরের কোনো কাজ করেননা, পতি, শ্বশুর বা ভাসুরের সেবা করেননা, সন্তানলাভ না হওয়ায় তেমন লজ্জিতও নন। কনিষ্ঠ দেবরটির সারস্বত সাধনায় এতোখানি অংশগ্রহণ তাঁর পক্ষে আদৌ শোভন কি, যেখানে জ্ঞানদানন্দিনীর দুই ছেলে মেয়ে রবিকাকে এতো ভালোবাসা সত্ত্বেও একটি বারও সেই ঘরে যাওয়ার সময় হয়না রবির? অথচ কাদম্বরীর কাছে ফিরতে মাঝসমুদ্রে জাহাজ থামিয়ে হঠাৎ বাড়ি চ’লে আসে সে (তা সে সঙ্গীর যতো অসুবিধাই যুক্তি হোকনা কেন)।

ইংলিশ একটি বিশেষ শব্দের ব্যবহার বর্তমানে আমাদের মধ্যেও ঘ’টছে, সেটি হ’লো ‘স্যাপিওসেক্সুয়াল’। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির দৈহিক অভিব্যক্তি বা উপস্থাপনা নয়, তার ‘বৌদ্ধিক প্রকাশের যে সান্নিধ্য, তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ’। সাদা বাংলায় ব্যক্তির মননের বিস্তৃতিতে চমৎকৃত হ’য়ে জেনে বা অজান্তে কেবলমাত্র সেইটুকুর প্রতি ধাবিত হওয়া। বিভিন্ন বিষয় থেকেই এর উৎপত্তি হ’তে পারে, কিন্তু মূলতঃ আসে জনৈকের ‘চিন্তার নতুনত্ব’ থেকে। উভয়পক্ষ পরস্পরের বিপরীত লিঙ্গের মানুষ হ’লে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় মাত্র। কাদম্বরী ও তাঁর দেবর মূলতঃ পরস্পরের এই অংশটুকু সমানভাবে উপভোগ ক’রতেন। এই বিষয় বুঝতে গেলে সমাজের চিন্তনে যতোখানি বিস্তৃতি প্রয়োজন তা এখনও আসেনি, সে সময় তো তা আরোই দুর্লভ।

কিন্তু রবি আর কাদম্বরীর এই সম্পর্কের ভেতরে একটি ছোটো পার্থক্য ছিলো, তার নাম ‘অবহেলা’। সম্ভবতঃ তার বিরূদ্ধে অন্তঃস্থিত বিদ্রোহ থেকেই নিজের আপাত-সর্বনাশের দিকে ধাবিত হন কাদম্বরী। ‘নতুন বৌঠান’ শব্দটি ব’ললেই যে অত্যন্ত ইতর চিন্তাভাবনাগুলি তাঁর দেবর সম্পর্কে আমাদের মাথায় আসে সেগুলির কোনোটির সাথেই উপরোক্তর সম্পর্ক নেই। কাদম্বরী ঠিক কী কী পেয়েছিলেন তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে? নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসার গঞ্জনা, ব্যস্ত এবং পরবর্তীকালে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জ’ড়িয়ে পড়া স্বামী, স্নেহের পুত্তলী ঊর্মিলার মৃত্যুর দায়, অকারণে প্রতিযোগিতা ক’রে চলা জনৈকা শিক্ষিতা ভাজ এবং ঠাকুরবাড়ির পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিপ্রদত্ত কিছু বেড়ি। একটিই মাত্র মানুষকে তিনি অকৃত্রিম বন্ধু হিসাবে পেয়েছিলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে সে পুরুষ। জীবিতাবস্থায় যাঁর কোনো স্বীকৃতি ছিলোনা, ভারতীতে প্রকাশিত পত্রসাহিত্য কোন উপকার ক’রবে তাঁর? অমরত্ব মরণের পরেই প্রাপ্ত হয়, তার জন্য এতোদিনের ক্লেশের দায় কাকে দেবেন তিনি? সমাজ না স্বামী?

তাই “হেথা হ’তে যাও, পুরাতন। হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হ’য়েছে”র ধাক্কা কাদম্বরীকে একাই স’ইতে হ’য়েছিলো, জ্ঞানদানন্দিনী সেই স্থান পানওনি, অনুভবও করেননি। রবিও সম্ভবতঃ সেই নিষ্প্রাণ দেহ দেখার মুহূর্তেই কোনো এক ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে’ রূপান্তরিত হ’য়েছিলেন, যিনি জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন, যে অমরত্ব চিরকালীন হ’তে পারে কিন্তু অমরত্ব লাভ ক’রতে কিছু করার মতো সময় নেহাতই কম। আমি কি তবে এই প্রমাণ ক’রতে চাইছি যে কাদম্বরী যা ক’রেছিলেন তা একেবারেই ঠিক? তা কখনোই নয়, কিন্তু সে দোষ তাঁর একারও নয়। তিনি কি তবে ব্যভিচারিণী? একরকম তাইই, তবে সে ব্যভিচার আমাদের পরিচিত ঘৃণ্য চারিত্রিক বিশ্বাসঘাত নয়, বিদ্রোহ তাঁকে পতিব্রতা থেকে আপামর পৃথিবীর নারীজাতির দুঃখকষ্টের প্রতিভূ ক’রে তুলেছিলো মাত্র। জ্ঞানদানন্দিনীও তাঁর নিজস্ব প্রেক্ষিতে একশো শতাংশ ঠিক ছিলেন, শুধু বুঝতে চাননি মননের জন্য নিয়মের সৃষ্টি নয়, নিয়ম স্বয়ং এককালীন মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন। রবীন্দ্রসাহিত্যে নারীমননের দুই প্রকারেরই উল্লেখ আছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শুধু নিজের প্রথম প্রত্যক্ষ শিক্ষাগুরুকেই আজীবন স্মরণে রেখেছেন। ‘কাদম্বরী মরিয়া প্রমাণ করিয়াছিলেন, তিনি জীবিত ছিলেননা’। কিন্তু তিনি আমাদের যে উপহারটি দিয়ে গেলেন, কোনো নারী দিবসই তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাতে যথেষ্ট হয় কি?

ধন্যবাদ।

Loading

Leave A Comment